♥গল্প♥ পর্ব_২
♥♥♥
শেখ ভিলায় পা দিতেই রওশন বেগমের মুখোমুখি ফারহান । মায়ের চোখ বলে দিচ্ছে অনেক অভিমান জমে আছে ৷ কি করবেন ? মা তো তিনি । রওশন বেগমের চোখের মনি ফারহান ৷ ২৮ টা বছর বুকের মাঝে করে রেখেছেন ছেলেকে তিনি ৷ ছেলে কানাডা থেকে সোজা অফিসে চলে গেছে শুনে অভিমানের পাহাড় জমে আছে মায়ের মনে ।
মায়ের অভিমান টুকু ভাঙানোর ট্রিক্স ফারহানের বরাবরই জানা । ফারহান জানে তার মাকে কিভাবে ভুলাতে হয় । ফারহানের মুখে একটু হাসি দেখলেই মা তার সব কিছু ভুলে যান । তাই ফারহান কিছু না বলে সবার আগে মিষ্টি করে একটা হাসি দেয় আর রওশন বেগম সেখানেই কাত হয়ে যায় । মাশা-আল্লাহ তার ছেলে লাখে একটা । যেমন হাইট তেমন গায়ের রঙ তেমন চাহনি এমন ছেলে ভাগ্য করে পাওয়া যায় । তবে ছেলের জেদ প্রচুর । রাগ উঠলে দুনিয়া এপাশ থেকে ওপাশ করে ফেলে । তবে ফারহান আর যাই হোক নিজের পরিবারের বিষয়ে খুব সচেতন । তাদের কাউকে কখনও কষ্টে সে রাখে না ।
রওশন বেগম কিছু না বলে সোফায় গিয়ে বসেন । আর ফারহানও রেডি হয় তার মাকে মানানোর জন্যে ।
ছেলের কথা শুনে রওশন বেগম মুখ বাকিয়ে বলে ,
মারুফা হলো এ বাড়ির কাজের মেয়ে । অনেক আগে থেকেই কাজ করে এখানে সে । মারুফা দৌড়ে এসে ফারহানকে বলে ,
ওদের কথায় রওশন বেগম হেসে দেন । রওশন বেগমের হাসি দেখে ফারহান মাকে জড়িয়ে নেয় ।
ছেলের এই এক দোষ । ছেলে বাড়িতে খায় বলতে শুধুই সকালের নাস্তা । দুপুরে লাঞ্চ সে কবে করেছে তার জানা নেই । আর রাতের ডিনার ক্লাইন্টদের সাথে । ছেলের কিছু বদ অভ্যাস ত্যাগ করানোর লাগবে ৷ আর তার জন্যে একটা বউ আনা লাগবে । আর রওশন বেগম সেই ব্যবস্থাই করবেন ।
পরদিন বিকেল ৪ টা ,
বেখেয়ালি ভাবে হেটে যাচ্ছে অয়নন্দিতা । মন ভালো নেই তার । গতকাল যেই দুজন দেখতে এসেছিল তারা নাকি আজ সকালেই না করে দিয়েছে । ছেলের নাকি অয়নন্দিতাকে পছন্দ হয় নি । অথচ অয়নন্দিতাকে যে দেখবে সে কিছুতেই না করবে না , কিন্তু ছেলেটা কেন না করলো তাই-ই ভেবে পাচ্ছে না সে । এ নিয়ে বাসায় ঝামেলাও হয়েছে । অয়ন বাসায় এসে সব শুনে চিল্লাপাল্লা করেছে । অয়নন্দিতার বাবাও ওইখান থেকে রোকেয়া বেগমকে বকা দিয়েছে । সবার ধমক খেয়ে বেচারি রোকেয়া বেগমেরও মন ভালো নেই ।
এইসব ভাবছে আর হেটে যাচ্ছে সে । হঠাৎই ফোন বেজে উঠে তার । হাতের মোবাইল টার দিকে নজর করতেই দেখে তার ভাইয়ের ফোন । চট করেই ফোন রিসিভ করে নেয় অয়নন্দিতা ।
কথা শেষ করে একটু সামনে এগুতেই দেখে একজন ভদ্র টাইপ লোক একজন রিক্সাওয়ালাকে মারছে এবং থাপ্পড় দিচ্ছে । তার উপর রিক্সাওয়ালা বয়স্ক লোক । অনেকটা অয়নন্দিতার বাবার মত । ব্যাপার টা অয়নন্দিতার একদম ভালো লাগে নি । এই জিনিস গুলোর প্রতি অয়নন্দিতার বেশ দুর্বলতা আছে । যেমন , রিক্সাওয়ালার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে , বিনা কারণে মারধর করা যা অয়নন্দিতার একদম পছন্দ নয় । অয়নন্দিতা নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে নি । দ্রুততম গতিতে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় সে । সেখানে গিয়ে দেখে বয়স্ক মানুষটার মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে তবুও এই ভদ্র টাইপ লোকটা থাপড়াচ্ছে । অয়নন্দিতা সেই মুহুর্তে নিজের মেজাজ আর নিজের বশে রাখতে পারে নি । ওমনি বলে উঠে ,
অয়নন্দিতার এমন কথায় ওই লোক ঘাড় বাকিয়ে তাকায় । ভ্রু কুচকে বলে ,
তখনই রিক্সাওয়ালা কাঁদতে কাঁদতে বলে ,
লোকটার কান্না দেখে অয়নন্দিতার চোখে পানি চলে আসে । মেয়েটা যে এমনি । কারো কষ্ট যে তার সহ্য হয় না । এইসবের মাঝে লোকটি আবারও রিক্সাওয়ালাকে মারতে যায় আর ওমনি অয়নন্দিতা তার হাতটা ধরে ফেলে ,
রাস্তার সব মানুষ তখন অয়নন্দিতা আর ওই লোকের তর্কাতর্কি দেখছে । অনেকে তো ভিডিও করছে ।
গাড়িতে অনেক্ষণ যাবত অপেক্ষা করে হাপিয়ে গেছে ফারহান । কিসের এত জ্যাম এখানে । সামনে লোকের ভিড় দেখে গাড়ি থেকেই একজনকে প্রশ্ন করে ফারহান ,
ওই ভদ্রলোক ফারহানকে দেখেই চিনে ফেলেন । এই শহরের টপ বিজনেসম্যান সে , তাকে কে না চিনে । তবে ওই লোক অবাক হয় ফারহানের কথা শুনে । একদম সাধারণ মানুষের মত কথা তার । অবশ্য ফারহান এমনই । যখন যেখানে যেভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করা উচিত সে সেইভাবেই নিজেকে প্রেজেন্ট করে । লোকের থেকে জবাব না পেয়ে ফারহান আবারও প্রশ্ন করে ,
লোকটির কথায় ফারহান হেসে দিয়ে জবাব দেয় ,
ফারহানের কথাটা কেমন যেন লাগছে । একটা মেয়ে প্রতিবাদ করছে । ব্যাপার টা বেশ মজার এখনকার মেয়েরা তো ঘরের কোণে বসে থাকে । এই মেয়ের সাহস আছে বলতে হয় । ফারহানের এই ভাবনার মাঝেই তার গাড়ির গ্লাসে কারো হাত পড়ে । ফারহান তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে হাত দিয়ে গ্লাসটাকে পুষ করতে চাইছে । ফারহানও কৌতূহলবশত গ্লাস নামিয়ে দেয় ।
একটা স্নিগ্ধ মায়াবী চেহারা তার সামনে । যার চোখ গুলো দেখলেই হারাতে ইচ্ছে করে বহুদূর । আর সেই মায়াবী চেহারার মেয়েটি মানে অয়নন্দিতা তখন ফারহানের কাছে সাহায্য চাইছে ,
ফারহান আরেকটু অবাক হয়ে যায় । কন্ঠ টা বেশ সুরেলা । দারুণ বললেও কম হবে । ফারহান দেখেই যাচ্ছে সাথে শুনেই যাচ্ছে । অয়নন্দিতা আবারও বলে ,
অয়নন্দিতার কথাবার্তা আর হাইপার হয়ে যাওয়া দেখে ফারহান বুঝে যায় , কিছুক্ষণ আগে যেই মেয়ের কথা বলা হয়েছে এই মেয়েটি সেই মেয়েটিই । দিক বিক না ভেবেই ফারহান অয়নন্দিতাকে গাড়িতে বসতে বলে আর অয়নন্দিতাও ওই বয়স্ক রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে ফারহানের গাড়িতে বসে যায় ।
গাড়ি হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ায় । অয়নন্দিতা কোন রকম নেমে ওই লোকটিকে নিয়ে ভেতরে নিয়ে যায় । ফারহান তখন গাড়িতেই বসা । একটাবারের জন্যেও ধন্যবাদটুকু জানায় অয়নন্দিতা তাকে । এই মুহূর্তে অয়নন্দিতার মাথায় একটাই চিন্তা লোকটাকে ট্রীটমেন্ট করাতে হবে । বাকি সব চিন্তা দূরে আছে ।
তাড়াহুড়োয় অয়নন্দিতা ভুলেই গেছে যে এটা একটা প্রাইভেট হাসপাতাল । ওইদিকে লোকটার মাথায় দুটো স্টিচ দেয়া হয় । ভালো মত দেখে ডক্টর ১০ দিনের মেডিসিনও দিয়ে দেয় । অয়নন্দিতার মাথা ঘুরে যখন বিল দেখে । রিসিপশনে বিল পে করার জন্যে তাকে রিসিট দেয়া হয় । সব মিলে ১০০০০ টাকা । এই অল্প একটু সেলাই আর মেডিসিনের জন্যে বুঝি ১০০০০ টাকা লাগে । পরে দেখে এটা প্রাইভেট হাসপাতাল ।
এই মুহুর্তে অয়নন্দিতার মেজাজ খারাপ হচ্ছে ওই লোকটা মানে ফারহানের প্রতি যে কিনা তাদের এখানে নিয়ে এসেছে । এখন অয়নন্দিতা বিল পে করবে কিভাবে । পার্স হাতিয়ে সব মিলিয়ে ৩৪২০ টাকা আছে । বাকি ৬৫৮০ টাকা এখন সে কোথা থেকে দিবে ? বড় মুশকিল তো ? নিজের ভাইকে ফোন দিবে ভাবছে ।
এমন সময় কে যেন তার হাত থেকে রিসিট টা টান দিয়ে নিয়ে যায় সোজা রিসিপশনে চলে যায় । সেখানে বিলও পে করে দেয় । অয়নন্দিতা তাকিয়ে আছে তার দিকে । ছেলেটা বেশ হ্যান্ডসাম , নেভি-ব্লু রঙের শার্ট পরা তাও আবার হাতা ফোল্ড করা । হাটার স্টাইল টাও বেশ সুন্দর । সেই ছেলেটা আর কেউ নয় সে ফারহান ছিল । বাকি রিসিট টা নিয়ে এসে অয়নন্দিতার হাতে ধরিয়ে দেয় আর বলে ,
এমন সময় সেই বয়স্ক লোকটা আসে । প্রাণ ভরে দোয়া দিয়ে যায় ফারহান আর অয়নন্দিতাকে । যাওয়ার সময় ফারহান বয়স্কের হাতে আরও দু’হাজার টাকা দিয়ে দেয় ফল খাওয়ার জন্যে । লোকটা চলে গেলে ফারহান অয়নন্দিতাকে বলে ,
কথাটা অয়নন্দিতার বেশ গায়ে লাগে তাই সেও বলে উঠে ,
ফারহান এই বলে চলে যেতে নিলে অয়নন্দিতা বলে উঠে ,
পিছু ফিরে ফারহান হেসে দিয়ে বলে ,
অয়নন্দিতার আত্মসম্মান অনেক বেশি । তাই ফারহানের কথা গুলো সহজেই গায়ে লেগে যায় তার । সাথে সাথে নিজের কানে থাকা ছোট দুল জোড়া খুলে ফারহানের হাতে ধরিয়ে দেয় । অয়নন্দিতার এইসব আচরণ দেখে ফারহান বেশ অবাক হয়ে যায় ।
এই বলে অয়নন্দিতা সোজা চলে যায় আর একবারের জন্যেও পেছন ফিরে তাকায় নি সে । আর ফারহান যেন স্তব্ধ হয়ে অয়নন্দিতার দেয়া দুল জোড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার । এক রত্যি মেয়ে কিনা হাতে স্বর্ন ধরিয়ে দিয়ে যায় । তাও আবার ফারহান শেখের হাতে ।
দুজনের সাক্ষাৎটা কাকতালীয় হলেও এই ক্ষনিকের সাক্ষাৎকারে কিছু বাজে স্মৃতি জমা হয়ে গেছে ।।
চলবে………………………
লেখকঃ জান্নাতুল ফেরদৌস
Leave a Reply