গল্প
অয়নন্দিতার বাবা হামিদ সাহেব তার ভাই এবং শ্যালকদের সাথে আলাপ আলোচনা করে ঠিক করে ফারহানের বাসায় যাওয়ার ডেট ফিক্সড করে । আগামীকাল সবাই মিলে ফারহানের বাড়ি যাবে হয়তো সেখানেই বিয়ের ডেট দিয়ে আসবে । বাবা মায়ের হাজার টা স্বপ্ন থাকে মেয়ের বিয়ে নিয়ে । সন্তানের বিয়ে নিয়ে এক একজনের মনের বাসনা থাকে এক এক ধরনের । সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তা দিয়েই মেয়ের বিয়ের আয়োজন করবেন হামিদ সাহেব ।পরদিন , সবাই মিলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত । ফারহানের পরিবার থেকে তাদের বলা হয়েছে দুপুরে খাওয়ার জন্য । হামিদ সাহেব কয়েকদফা ফোন করে নেয় অয়নকে । কিন্তু বেচারা অফিসে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আসতে পারছে না । ওদিকে অফিসে বাবার ফোন পেয়ে ফোন রিসিভ করে অয়ন ।- আসসালামু আলাইকুম বাবা , – কোথায় তুই ? আসবি কখন ? – বাবা তোমরা যাও , আমি তো বের হতে পারছি না । – এটা কি বললি তুই বাবা ? – বাবা নতুন শিপমেন্ট নিয়ে কাজ চলছে আমার দম ফালানোর সুযোগ নেই । – ওইদিকে রমজান সাহেব ফোন করে বললো তোকেও যাতে নিয়ে যাই ।- তোমরা যাও আল্লাহর নাম নিয়ে । গিয়ে আমায় ফোন করো , আমি আংকেলের সাথে কথা বলে নিবো , কেমন ? – এখন কি একেবারেই যেতে পারবি না বাবা ? – নাহ বাবা , সম্ভব হলে কি আমি না যাওয়ার মানুষ , বলো । – নিজে এত শখ করে বোনের জামাইর জন্যে আংটি কিনলি অথচ তোকে রেখেই যাবো । – এটা কি বলো বাবা । ভাই হিসেবে আমার কর্তব্য আমি করে যাবো । এটা নিয়ে কষ্ট পেও না । তোমরা বেরিয়ে যাও আল্লাহর নাম নিয়ে । – আচ্ছা তাহলে আমরা যাই , কেমন ? – আচ্ছা , ফি আমানিল্লাহ !ছেলের সাথে কথা বলে ব্যাথিত মনে লাইন কেটে দেন হামিদ সাহেব । তার ছেলে অয়ন বেশ শান্ত স্বভাবের । নিজের দায়িত্ব গুলো নিজে বুঝে নিয়েছে সর্বদা । কখনও এদিক থেকে ওদিক হয় নি তার । ভেবেছিল বাপ ছেলে একত্রে গিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি দেখে আসবে । কিন্তু কিছুই হলো না । রোকেয়া বেগমের সাথে কথা বলে তারা মোট ৬ জন পুরুষ বেরিয়ে গেলেন শেখ ভিলার উদ্দেশ্যে ।পাশের রুম থেকে অয়নন্দিতা সবটাই শুনতে পেয়েছে । ভয়ে তার সব কিছু দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে । আজ হয়তো বিয়ের ডেট দিয়ে আসবে তারা । ফারহান গতকালই বলেছিল যে যত দ্রুত সম্ভব সে অয়নন্দিতাকে তার ঘরে নিয়ে যাবে । সেদিক থেকেও একটা ভয় থেকেই থাকে ।শেখ ভিলা , দুপুর আনুমানিক ২ টা বেজে ৩৫ মিনিট । নিচে ড্রইংরুমে সবাই মিলে বসে আছে । হামিদ সাহেব একদিকে আনন্দিত অন্যদিকে শংকিত । এত বড় বাড়িতে সম্বন্ধ করেছেন । কি করে এদের দাবি মেটাবেন তিনি । মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ তারা । অন্যদিকে , অয়নন্দিতার চাচা মামারাও অবাক । নিজেদের ভাগ্নির জন্যে এমন বড় জায়গা থেকে প্রস্তাব আসায় সবাই বেশ খুশি ।দুপুর বেলা বলে তেমন নাস্তা পানির আয়োজন করা হয় নি । জালকা পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় তাদের । সবার সাথে কথা বলতে শুরু করেন রমজান শেখ এবং তার স্ত্রী রওশন বেগম ।- ভাই , আপনার ছেলেকে আনলেন না ? – ও প্রচুর ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অফিসে , অনেক চেষ্টা করেছিল নাকি । কিছুতেই সম্ভব হয় নি । – ওহ আচ্ছা ।তখন অয়নন্দিতার এক মামা বলে উঠেন ,- ভাগিনা আমাদের লাখে একটা । এমন ছেলে ভাগ্য করে পাওয়া যায় । আমাদের বোন দুলাভাইয়ের ঘরে এমন ছেলে যা আমরা কখনও ভাবিও নি । তেমনি আমাদের ভাগ্নি । – হ্যাঁ , আমরা সবটাই শুনেছি ভাই ।সবার হালকা পাতলা কথার মাঝে অয়নন্দিতার বড় চাচা বলেন ,- ভাই , আমাদের জামাই কোথায় ? – আপনাদের জামাই উপরে রেডি হচ্ছে , এখনি নামবে ভাই । – ওহ আচ্ছা ।তখনই রওশন বেগম মারুফাকে উপরে পাঠান ফারহানকে বলার জন্যে ।এদিকে , ফারহান ড্রেসিং টেবিলের সামনে ড্রেস ট্রায়াল দিচ্ছে । আর সাজি পাশে বসে দেখছে আর হাসছে ।- এই তুই এত হাসছিস যে ? – তুই এইভাবে রেডি হচ্ছিস যেন আজই তোর বিয়ে । – শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসেছে , রেডি হতে হবে না ? – এই ভাইয়া , তুই আমার ভাইয়া তো ? – মানে কি ? – যেই ভাইয়ের আমার ৫ টা গার্লফ্রেন্ডকে ভাগলো , যে ভাই আমার বিয়ের নামে এলার্জি সেই ভাই কি এমন দেখলো সেই অপ্সরার মাঝে যাকে সে একেবারে বউ করেই নিয়ে আসছে । – তুই গেলি না কেন ? – আমার সেইদিন সন্ধ্যায় বার্থডে পার্টি ছিল , তাই যাওয়া হয় নি । – গেলে দেখতে পারতি । – মায়ের কাছে শুনেছি , সে সত্যিই নাকি খুব সুন্দর । – হ্যাঁ ,এরই মাঝে মারুফা ঘরে আসে ,- কত সাজন সাজবেন , এইবার লন তো ।মারুফার কথা শুনে ফারহান আর সাজি দরজার দিকে তাকায় ।- কি হয়েছে ? – খালাম্মায় নিচে যাইতে কইছে । – তোকে না কতবার বলেছি ভাষা ঠিক কর । – হুনেন ভাইজান আপনাগো ওই পে পো আমি কইতাম ফারি না । অহন লন তো ।মারুফার কথায় সাজি হেসে দেয় ।- তুমি কি সব কথা মারুফা আপু , পে পো কি আবার , হা হা । – তুমি আর দাত দেহাইও না । তাত্তাড়ি তোমার এই ভাইডারে নিয়া আহো তো নিচে । আমি গেলাম ।মারুফা নিচে চলে গেলে ফারহান সাজির দিকে আর সাজি ফারহানের দিকে তাকায় ।- কবে যেন এই মারুফাকে আমি মারি ? – ওহ মাইয়া চল তো , আর রাগ তোর ওই শার্টের পকেটে রাখ । এখন চল ।সিড়ি দিয়ে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে নামতে দেখে সবাই সিড়ির দিকে তাকায় । অয়নন্দিতার পরিবারের সবাই ভেবে নেয় ইনিই হয়তো তাদের জামাই । অয়নন্দিতা বাবা বেশ গভীর নয়নে তাকিয়ে আছে চশমার ভেতরে । কালো প্যান্ট , সাদা শার্ট ইন করা , হাতা গুলো ফোল্ড করা , বেশ ভালো লম্বা চওড়া , সুদর্শন চেহারার একজন পুরুষ সে । অয়নন্দিতার বাবার দেখেই মন জুড়িয়ে গেছে । এদিকে ফারহান এসে সবাইকে ” আসসালামু আলাইকুম ” বলে সালাম দেয় । ফারহানও যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করে তাদের সাথে ।- আংকেল দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনারা , বসেন ।ফারহানের কথায় সবাই বসে । এদিকে সাজিকেও পরিচয় করিয়ে দিলে সাজিও সবাইকে সালাম দেয় । রমজান সাহেব বলেন ,- এই দুইজনই আমার সন্তান । ফারহান বড় আর এটা তো এইবার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ফোর্থ সেমিস্টার আছে । – ওহ আচ্ছা ।তারপর রমজান শেখ নিজেই ফারহানের সাথে অয়নন্দিতার বাবার পরিচয় করিয়ে দেন । ফারহানও অয়নন্দিতার বাবার দিকে তাকায় । হামিদ সাহেবকে দেখে হুট করেই ফারহানের মন বলে ,- ভদ্রলোক তো যথেষ্ট শান্ত প্রকৃতির ।তবে ওনার মেয়েটা হচ্ছে উড়নচন্ডী । খুব অমায়িক লাগছে লোকটার চেহারাটা ।ফারহানের ভাবনার মাঝেই রমজা শেখ তাকে ডেকে উঠে । পাশ ফিরে চাইতেই তিনি ফারহানকে হামিদ সাহেবের পাশে গিয়ে বসতে বলেন । ফারহানও গিয়ে বসে সেখানে । ছেলেকে হামিদ সাহেবের কাছে পাঠিয়ে রমজান শেখ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ,- আপনাদের কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করতে পারেন আমার ছেলেকে ।প্রতিউত্তরে তারা সবাই বলেন ,- নাহ আর কি জিজ্ঞেস করবো । সব তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি ভাই । আলহামদুলিল্লাহ আমরা অনেক খুশি আপনাদের সাথে আত্নীয়তা হচ্ছে বলে ।কিন্তু অয়নন্দিতার বাবা সবার সামনে চুপ করে থাকলেও তিনি পরে একা কথা বলবেন ফারহানের সাথে এটাই মনে মনে ঠিক করেন ।সবার সব কথার পর অয়নন্দিতার বাবা হামিদ সাহেব ফারহানকে আংটি পরিয়ে দেয় । অন্যদিকে রওশন বেগমও খাওয়ার আয়োজন করে ফেলেন । তারপর সবাই মিলে খাওয়া দাওয়ার জন্যে বসে যান । ফারহান প্রথমে খেতে চায় নি । পরে সবাই বলায় সবার কথার মান রাখতে বসে পড়ে । খাওয়া দাওয়ার পর পরই সবাই মিলে যখন কথা বলছিল তখনই হামিদ সাহেব বলেন ,- আমি একটু ফারহানের সাথে আলাদা কথা বলতে চাচ্ছিলাম , বলা যাবে কি ?হামিদ সাহেবের কথা শুনে ফারহান কিঞ্চিৎ অবাক হলেও রমজান শেখ অনায়াসেই অনুমতি দিয়ে দেয় আর ফারহানকে বলে হামিদ সাহেবকে তার রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য । এদের বাপ বেটার ব্যাপার টা আলাদা । অফিসে বাপ ছেলের কথা শুনতে প্রস্তুত আর বাড়িতে ছেলে বাপের । একটু উল্টো এদের আচরণ গুলো । তবে সবার মাঝে বন্ধু সুলভ আচরণটাই বেশি । ফারহান হামিদ সাহেবকে নিয়ে উপরে আসেন । নিজের রুমে নিয়ে যায় সে । ফারহানকে একা পেয়ে হামিদ সাহেব কি বলবেন না বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না । তবুও সাহস করে বলেন ,- অয়নিকে কোথায় দেখেছিলে বাবা ?অয়নন্দিতার বাবার কথায় ফারহান বিষ্মিত হলেও সাহস নিয়েই জবাব দেয় ।- আমার এক বন্ধুর বিয়েতে । – ওহ আচ্ছা । তোমার বাবা মা হুট করেই চলে গেলেন আমার বাসায় । আমি তো ভেবেই পাই নি আমি কি বলবো বা কি করবো ? – তাদের আমিই যেতে বলেছিলাম । – হ্যাঁ , পরে তারা বলেছিলেন । – জ্বি , – বাবা অয়নি আমার খুব আদরের । খুব আদর করেই তাকে বড় করেছি আমি । এখন সে তোমার ঘরে আসবে । আমি একদিকে আনন্দিত অন্যদিকে শংকায় আছি । – আপনি তার বাবা , সব বাবারই মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা থাকে । আমার ঘরেও বোন আছে । সেদিক থেকে আমার বাবারও আমার বোনকে নিয়ে চিন্তা কম নয় । আপনাকে সবটা বলে পূর্ণ ভরসা দেয়ার মত সাধ্য আমার নেই তবে এইটুকু আস্থা রাখতে পারেন । আপনার মেয়ে আমার ঘরে এলে অসুখী হবে না ।ফারহানের কথা শুনে হামিদ সাহেব যেন ঘোরের মাঝে আছেন । ফারহান আবারও বলতে থাকে ,- আপনি জেনে অবাক হবেন , আপনার মেয়েকে দেখা মাত্রই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সে আর অন্য কারো ঘরে যাবে না । একমাত্র আমার ঘর ছাড়া । আমি কতটা ডেসপারেট হলে শুধুমাত্র এক সপ্তাহের মাঝে এতদূর চলে এসেছি । আংকেল বিশ্বাস না করতে পারেন ভরসা রাখেন । আর মনে হয়তো এই ভাবনা চলছে আপনার যে , এত বড় লোক বাড়িতে মেয়ে দিচ্ছেন ঝামেলা হবে কিনা , আপনার চোখ মুখ কিন্তু তাই-ই বলছে । সেক্ষেত্রে আমি আপনার ভাবনা বদলাতে পারবো না তবে একটা কথা বলতে পারি সব বড় লোকরা এক হয় না । সমাজে কিছু বড় লোক রমজান শেখের মতও হয় । এর থেকে বেশি কিছু আপনাকে বোঝানোর মত ক্ষমতা নেই আমার আংকেল ।হামিদ সাহেব অবাক সেই সাথে মুগ্ধ হয়ে ফারহানের কথাগুলো শুনে । তার পূর্ণ বিশ্বাস এসে গেছে তার মেয়ে আর যাই হোম এই ছেলের কাছে কখনও অসুখী হবে না । পানি ছলছল চোখে হাসি মুখে ফারহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় হামিদ সাহেব ।- বেঁচে থাকো বাবা । সুখে থাকো সারাজীবন । – আপনাদের দোয়া এবং ভালোবাসা থাকলে ইনশাআল্লাহ ভালো এবং সুখে অবশ্যই থাকবো ।ফারহানের কথায় স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়েন হামিদ সাহেব । আর কোন চিন্তা নেই তার । মেয়েকে সৎ পাত্রেই দান করতে যাচ্ছেন তিনি । মনে মনে এটা ভেবেই অনেক খুশি সে ।নিচে এসে ফারহানের বাবা মায়ের সাথে সব কথা সেড়ে নেয় অয়নন্দিতার পরিবার । এখন বাকি দেনা পাওনা নিয়ে । অনেক সংকোচনের পর অয়নন্দিতার বড় মামা দেনা পাওনার কথা তুলেন । তবে দেনা পাওনার কথা শুনে রাগ করেন ফারহানের বাবা মা । তখন রওশন বেগম বলেন ,- আপনাদের সবার দোয়া আর ভালোবাসা দিয়ে মেয়ে বিদায় দিবেন আর আমরা আমাদের ভাগের দোয়া আর ভালোবাসা দিয়ে বউ বরণ করবো । এটাই দেনা পাওনা । এর বেশি ভাই আর একটা কথাও বলিয়েন না । না হয় আমরা অপমানিত বোধ করবো ।রমজান শেখও বলেন ,- আপনাদের সকলের দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ আমার যা আছে তা আমার ছেলের তিন পুরুষ খেয়ে যেতে পারবে । দেনা পাওনার প্রশ্নই আসে না । আমি বরং আমার একমাত্র ছেলের বউকে গা ভরিয়ে আনবো । তবে আপনাদের কাছ থেকে কিছুই চাই না ভাই ।সকলে যেন এদের ব্যবহারে মুগ্ধ । সমাজে এদের মতও মানুষ হয় ? টুকিটাকি কথা বলে বিকেলের নাস্তা পানি করে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে সবাই বিদায় নেয় শেখ ভিলা থেকে ।আগামী সপ্তাহের শুক্রবার জুমার পর বিয়ের দিন ধার্য করা হয় অয়নন্দিতা আর ফারহানের ।।.চলবে………………………..
লেখক: জান্নাতুল ফেরদৌস
Leave a Reply