গল্প
সেদিন সারারাতেও বাসায় ফেরে নি ফারহান । একটা নির্ঘুম রাত পার করে অয়নন্দিতা । বার বার শুধু একটাই কথা ভেবে যায় সে । কি এমন কাজ পড়ে গিয়েছিল যে তার এই রাতের বেলাতেই বের হতে হয়েছে । বের হওয়ার পর রাতে সে আর বাসাতেই ফেরে নি ।সারারাত না ঘুমিয়ে ফজর নামাজ পড়ে নিচে নামার জন্যে পা বাড়ায় অয়নন্দিতা । সকাল সকাল রান্নাঘরে গিয়ে সবার জন্যে নাস্তার ব্যবস্থা করতে থাকে । সকাল প্রায় সাড়ে ৭ টা নাগাদ ফারহান বাসায় আসে । যা অয়নন্দিতার চোখ এড়ায় নি । শুধু অয়নন্দিতার চোখেই নয় বাকিদেরও চোখে পড়তো যদি না তারা তখন নিচে থাকতো । ফারহান সোজা নিজের রুমে গিয়ে ওয়াসরুমে যায় । শাওয়ার নিয়ে ভেজা চুলে বের হয় ফারহান । রেডি হয়ে যায় অফিস যাওয়ার জন্য । এর ভেতর অয়নন্দিতাও রুমে আসে নি । কারণ সে জানে এখন রুমে গেলেই সমস্যা বাড়বে । এক কথায় দুই কথায় ঝামেলা হবে প্রচুর । তাই সে নিচেই থেকে ।সাড়ে ৮ টা নাগাদ সবাই ডাইনিং রুমে একত্রিত হয় । তখনই রমজান শেখ ফারহানকে প্রশ্ন করেন ,- কি অবস্থা ফারহান , সব ঠিকঠাক আছে তো ? – হ্যাঁ বাবা , – তুমি কি কোন কারণে চিন্তিত নাকি ফারহান ? – নাহ তো , আই এম ফাইন ।অয়নন্দিতা শুধু চুপচাপ শ্রবণ করছে তাদের কথা গুলো । কত সুন্দর করে ফারহান কথা কাটাতে পারে তাই ভাবছে সে । অন্যদিকে , অয়নন্দিতার নজর যায় সাজির দিকে । প্লেটে খাবার নিয়ে বসে আছে সে , খাবার যেন ভেতরে যাচ্ছেই না তার । চোখ মুখের অবস্থাও ভালো না । সবার সামনে কিছু জিজ্ঞেসও করে নি , যদি অপ্রস্তুত মনে করে । তাই চুপচাপ থেকে যায় । ভেবে রেখেছে একা পেলে জিজ্ঞেস করে নিবে । সবাই নাস্তা করে যার যার মত করে চলে যায় । ফারহান অফিসে বের হয়ে যায় । সেদিন আর অয়নন্দিতার সাথে কথা বলে নি সে , আর অয়নন্দিতাও কিছু জিজ্ঞেস করে নি । রমজান শেখও অফিসে চলে যান । রওশন বেগম রান্নাঘরে টুকটাক কাজ দেখেন । এই সুযোগে অয়নন্দিতাও সাজির রুমে যায় । গিয়ে দেখে সাজি শুয়ে আছে । এই অসময়ে শুয়ে থাকা থেকে অয়নন্দিতা সাজিকে ডেকে উঠে ,- সাজি ,,,,,,,, ?অয়নন্দিতার কন্ঠ শুনে সাজি উঠে বসে । চোখ মুখের অবস্থাও ভালো না । যেন কান্না করেছে সে । অয়নন্দিতা গিয়ে পাশে বসে সাজির ।- তুমি কি অসুস্থ ? – কই না তো । – কান্না করেছো নাকি ? – উহু , – উহু না , কিছু তো হয়েছে ! -………….. – ঠিক মত নাস্তাও খেলে না । হয়েছে কি ? – আসলে ভাবী শরীরটা ভালো না । – আমি তোমার থেকে কিছুটা হলেও বড় , যেহেতু বড় সেহেতু অভিজ্ঞতাও বেশি । বলো তো কি হয়েছে , কান্না করছিলা কেন ?সাজি আর থাকতে না পেরে অয়নন্দিতাকে জড়িয়ে ধরে । চাপা স্বরে কেঁদে দেয় সাজি । এইভাবে হঠাৎ করে তাকে জড়িয়ে ধরবে এটা ভাবে অয়নন্দিতা । তার উপর আবার কাঁদছে সে । ঘটনা তো আছে , সাজির কি হয়েছে এমন ?- সাজি , কি হয়েছে ? আমায় বলো , কান্না করতেছো কেন ? – ভাবীইই ,,,,,,, – হ্যাঁ , বলো । কি হয়েছে ? – ভাবী আমার সব শেষ ? – সব শেষ মানে ? কি সব শেষ ? কি হয়েছে । – ভাবী , রাতুল আমার সাথে চীট করেছে ভাবী । – রাতুল ,,,,,? এই রাতুল কে ? – আমার ভার্সিটিতে পড়তো । আমি তাকে ভালোবাসি । – ওহ , এতে কান্নার কি আছে ? ভালো তো বাসতেই পারো । মা বাবাকে জানালেই হবে , – নাহ ভাবী , সব শেষ ?সাজির কথা গুলো অন্য কিছু ইংগিত করছিল । কিন্তু সেটা কি , এটাই বুঝতে পারে নি অয়নন্দিতা । আবারও জিজ্ঞেস করে সে ,- সাজি কি হয়েছে , একটু বলবা প্লিজ ? – ভাবী , আমি তাকে ভালোবাসতাম । কিন্তু আমি ভাবতাম সেও আমায় ভালোবাসে কিন্তু ,,,,,, – কিন্তু ,,,,,,? কিন্তু কি সাজি ? – সে তো আমায় ভালোবাসে না ভাবী । সে আমায় ভালোই বাসে নি কখনো । সে শুধু আমার সাথে ফিজিক্যাল হতে চেয়েছিল । যেই সে আমার সাথে ফিজিক্যাল হয়ে গেল ওমনি তার সুর টাও বদলে গেল । ভাবী গতকাল দুপুর ২ টার ফ্লাইটে সে নিউইয়র্ক চলে গেছে । – কিহহহহ ! – হ্যাঁ , ভাবী । এখন আমার শুধু ভয় হচ্ছে ভাবী , যদি আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যাই ? – সাজি ,,,,,,অয়নন্দিতার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায় । এটা কি বললো সে , এত বড় আর নামীদামি পরিবারের মেয়ে সে । কিন্তু কাজ টা কি করেছে সে ?- ভাবী , আমি মরেই যাবো । এইসব জানাজানি হলে মা বাবা ভাইয়ার মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে ভাবী । -…………….. – ভাবী , ও ভাবী কথা বলো না কেন ? একবার বলে দেও আমি কি করবো এখন ? – এই ঘটনা কবের সাজির ? – তোমার বিয়ের আগে , যেদিন মা বাবা তোমাকে দেখতে গিয়েছিল । – তার মানে ১৫ দিনের বেশি হয়ে গেছে ? – হ্যাঁ , ভাবী ।এমন সময় সেইখানে আরও একজনও উপস্থিত ছিলেন । আর সে হচ্ছেন সাজির মা রওশন বেগম । তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে । এটা কি শুনলো এইগুলো তিনি ? তার নিজের মেয়ের এত অধঃপতন হয়েছে , আর তার সেইদিকে কোন খেয়াল ছিল না । রাগে দুঃখে রুমের ভেতর ঢুকে নিজের মেয়েকে অয়নন্দিতার বুক থেকে টেনে নিয়ে তার সামনে দাঁড় করায় সে । সাজিকে স্থির হতেও সময় দেন নি তিনি ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় সাজির গালে । সাজিকে এইভাবে চড় দেয়ায় অয়নন্দিতাও চমকে উঠে ।- মা কি করছেন এইসব ? – তুমি সরে যাও , এই তুই কবে কবে এত বড় হয়েছিস ? হ্যাঁ , তুই এত বড় হয়েছিস কবে যে নিজের এত বড় ক্ষতি করে ফেললি ।সাজির মুখে আজ কথা নেই । শুধু চোখের পানি ছাড়া । সে আজ লজ্জিত , অপমানিত , নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস করে যার কাছে নিজেকেই তুলে দিয়েছিল আজ সেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে । সাজি নিজের সবটুকু হারিয়ে আজ এইটুকু বুঝেছে বেশ ভালো করেই যে মানুষ চিনতে কখনও কখনও সত্যিই অনেক বড় ভুল হয় । ভালোবাসার মান অন্তত সবাই রাখতে পারে না । ভালোবাসার সত্যিকার মান শরীর পাওয়াতে নয় , মন পাওয়াতে হয় ।রওশন বেগম কান্না করতে করতে ফ্লোরে বসে পড়েন । সাজির কান্নার অন্ত নেই । আর অন্যদিকে , অয়নন্দিতার মাথা এই মুহুর্তে কাজ করছে না । কি করবে সে এখন , কাকে সামলাবে ? শ্বাশুড়ি নাকি ননদ নাকি নিজের ভেতরের আগুন যেই আগুনে তাকে পুড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত । এমতাবস্থায় , রওশন বেগমের কান্নার বেগ অতিমাত্রায় বেড়ে যায় । রওশন বেগম ব্লাড প্রেশারের রোগী , তার উপর ডায়াবেটিস ।
বেশি কান্নাকাটি করলে স্ট্রোক করার সসম্ভাবনা অতিরিক্ত । পানির গ্লাস নিয়ে শ্বাশুড়ির সামনে বসে অয়নন্দিতা । আর রওশন বেগম এই মুহূর্তে ছেলের বউকে দেখে আরও ভেঙে পড়েন ।- অয়নন্দিতা , এখন আমি কি করবো বলতে পারো ? সব শেষ করে দিছে এই জানোয়ারের বাচ্চা টা । – মা , কি বলেন এইসব । থামেন , ও কি বাচ্চা নাকি এইভাবে গালিগালাজ করিয়েন না । থামেন মা । – তোমার বাবা জানলে ও-কে মেরেই ফেলবে । আর ফারহান ? ফারহান জানলে তো ও-কে খুনই করে ফেলবে । – মা ,,,,,, – এই খবর কারো কানে গেলে মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে । ওর বাপ ভাইয়ের এতদিনের অর্জন করা সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে । হায় আল্লাহ , আমি এখন কি করবো । – মা আগে আপনি শান্ত হোন । বাসায় কাজের বুয়া আছে মা , চুপ করেন । – ও যে শুয়ে বসে আসছে , ও তো একবারের জন্যেও বলে নি । সবাই তো এখন আমার শিক্ষা নিয়ে কথা বলবে । সবাই বলবে আমি কেমন মা যে তার মেয়েকে বেঁধে রাখতে পারি নাই । – সবাই জানলে তো বলবে মা । – ও-কে আমি কার কাছে বিয়ে দিবো । এই ঘটনা জেনে শুনে কে বিয়ে করবে ও-কে । – মা আগে আপনি শান্ত হোন । চুপ করেন মা , আপনি রুমে যান । – দেখি তুমি সরো , ও-কে আমি একটু জিজ্ঞেস করি , ওর এত সাহস কিভাবে হলো , দেখি সরো ।অয়নন্দিতা জানে রওশন বেগমকে স্পেস দিলে তিনি মারবে সাজিকে । তাই জোর করে সে রওশন বেগমকে সাজির রুম থেকে বের করে । মা চলে যাওয়ার পর বড় বোনের মত ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় সাজি ।এখনকার যুগের ছেলে রাতুল । অয়নন্দিতার ভয় কোন ভিডিও করেছে কিনা । তাই নিজেই ফ্রী হয়ে সাজিকে জিজ্ঞেস করে ,- সাজি , যেই রুমে তোমরা ছিলে সেখানে কোন ক্যামেরা ছিল ? – তা দেখি নি ভাবী । – কোন মোবাইলে ভিডিও করেছে ওই ছেলেটা ? – ওইসব কিছু দেখি নি । – তাহলে দেখেছো টা কি ? – ভাবী তেমন কিছুই দেখি নি । রুমে ঢুকার সাথে সাথেই,,,,,,,,,- থামো , এইবার বুঝেছো তো তার ভালোবাসার নমুনা । যে তোমার শরীর পাওয়ার জন্যে এত উতলা ছিল তার ভালোবাসা কেমন হবে ? – বুঝতে পারি নি তখন ভাবী । পাগলের মত ভালোবেসে গেছি শুধু । – তুমি কি ১৬/১৭ বছরের কিশোরী নাকি সাজি ? তুমি ২০+ , তবুও বুঝতে পারলে না ? – অন্ধ ভাবে ভালোবাসলে যা হয় আমারও তাই হয়েছে ভাবী । – এই শিক্ষাটা হয়তো তোমার জন্য প্রয়োজন ছিল । মনে রাখবে যে , ভালোবাসা ভালো অতিরিক্ত ভালোবাসা ভালো না । বিশ্বাস করা ভালো কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস ভালো না । – ভাবী নিজের কাছে নিজেকে খারাপ চরিত্রের মনে হচ্ছে । ইচ্ছে করতেছে নিজেকে শেষ করে দেই । – একদম না সাজি , খবরদার একদম না । এইসব চিন্তা মাথা থেকে সরাও । নিজেকে খারাপ চরিত্রের মনে হয় মানে কি ? তুমি তো ভালোবেসেছিলে , আর সে তোমাকে বোকা বানিয়েছে । আপাতত এইসব কাউকে বলো না । আমি দেখছি কি করা যায় । – কি করবা ভাবী ? – তার আগে ভাবতে হবে যাতে খারাপ কিছু না ঘটে । রেস্ট নাও , আমি একটু আসছি ।নতুন চিন্তা ভর করেছে অয়নন্দিতার মাথায় । নিজেই আগুনে জ্বলে যাচ্ছে , তার উপর আরেক সমস্যা । কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না সে ।এভাবেই কেটে যায় দু’দিন । রমজান শেখ আর ফারহান বাসায় থাকলে কোন কথা হয় না । কিন্তু যেই তারা বাসা থেকে চলে যায় তখনই রওশন বেগম শুরু করেন । তিনি পারেন না মেয়েকে একদম মেরে ফেলেন । মেয়ে যে কাজটাই করেছে এমন । লজ্জায় তিনি অয়নন্দিতার সাথেও কথা তেমন বলেন না । এই জিনিসটা অয়নন্দিতা আজ দু’দিন যাবত খেয়াল করে । মারুফাকে অন্য কাজে পাঠিয়ে দিয়ে অয়নন্দিতা রান্নাঘরে থাকে রওশন বেগমের সাথে ।- মা ,,,? – হ্যাঁ বলো , – মা আপনি কি আমার উপর রাগ ? – নাহ , – তাহলে আমার সাথে যে ঠিকমত এখন আর কথা বলেন না ? – ইচ্ছে করেই বলি না । – কেন মা ? আমি কি কিছু করেছি ? – নাহ , – তবে ? – কি কথা বলবো , বলতে পারো ? তুমি পরের মেয়ে । ভালোবেসে আমার ছেলে তোমায় এই ঘরে নিয়ে এসেছে । এসেই দেখতেছো , এই ঘরের মেয়ে যাকে কিনা এত আদরে বড় করা হয়েছে সেই মেয়ে আজ অন্যের সাথে শুয়ে বসে আসে । এই ঘর এই পরিবার নিয়ে তোমার কি চিন্তাভাবনা হবে তাই ভেবে কথা বলতেও লজ্জা লাগে আমার ।শ্বাশুড়ির কথায় নিজেকে ছোট মনে হয় অয়নন্দিতার । ছোট মনে হয় এই ভেবে যে হয়তো সে এই পরিবারের আপন হয়ে উঠতে পারে নি ।- মা , এখন তো মনে হচ্ছে আমিই আপনাদের আপন হয়ে উঠতে পারি নি । – নাহ নাহ মা , তা না । – তা-ই মা , একদমই তাই । না হয় আপনি পরের মেয়ে বলতেন না ।- অয়নন্দিতা ভুল বুঝো না মা । – মা , বিয়ে হয়ে যখন এই বাড়িতে এসেছি , এটাই আমার বাড়ি আর আপনারাই আমার আপন জন । আর সাজিও আমার ছোট বোনের মত । আমার কাছে ফারু যেমন সাজিও তেমন মা ।ছেলের বউয়ের কথা শুনে কেঁদে দেন তিনি । মনে মনে একটাই ভয় যদি সব জানাজানি হয়ে যায় । মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে । এদিকে , শ্বাশুড়ির কান্না দেখে কাছে গিয়ে ভরসার হাত নিয়ে শ্বাশুড়ির হাতে হাত রাখে অয়নন্দিতা । ছেলের বউয়ের হাতে ভরসা আর চোখে মুখে ছিল আস্থা । এমন একটা মেয়ে তার ছেলের বউ হয়ে এই ঘরে এসেছে যার উপরে চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস এবং ভরসা দুটোই করা যায় ।- কি করবো এখন অয়নন্দিতা , কত দিন এইভাবে লুকিয়ে রাখবো ? তোমার শ্বশুর জানতে পারলে সবার আগে আমায় ধরবে । আর বলবে সারাদিন আমি কি করেছি , যে মেয়ে এত নিচে নেমেছে । – না আমি বলবো , না আপনি বলবেন , না সাজি । আমরা সবাই চুপচাপ থাকি তাহলেই হবে । – অন্য কোথা থেক শুনলে ? – মা , ওই ছেলে এখন বাহিরে চলে গেছে , আর কার কাছ থেকে শুনবে বলেন ? আর সাজিকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম , ও বলেছে আর কেউই জানে না । – আমি এখনও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না অয়নন্দিতা , যে আমার মেয়ে । আমার শিক্ষায় কি এতই ঘাটতি ছিল যে আমার মেয়ে এইভাবে ? – মা বাবা কখনই ছেলেমেয়ের শিক্ষায় কমতি বা ঘাটতি রাখে না । ঘাটতি থেকে যায় আমাদের মত ছেলেমেয়েদের চিন্তাধারায় । – তোমার মা তো রত্নগর্ভা যার তিন টি সন্তানই মানুষের মত মানুষ । তোমার বাবা তো একজন আদর্শ পিতা । – আপনিও একজন আদর্শ মা আর বাবাও একজন আদর্শ পিতা । এইসব বলে নিজেদের ছোট করবেন না মা । – অয়নন্দিতা , আজকে তোমাকে আমায় একটা কথা দিতে হবে ? – বলেন মা । – এই কথা তুমি কাউকে বলবে না ।– এই কথা তুমি কাউকে বলবে না । – কথা দিলাম মা কেউ জানবেও না আর শুনবেও না । – বাঁচালে আমায় তুমি মা । আমি সাজির বিয়ে দিয়ে দিবো । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব । – কি বলছেন কি মা আপনি এইসব । – হ্যাঁ , যত তাড়াতাড়ি পারি বিয়ে দিয়ে দিবো । – এত তাড়াতাড়ি ছেলে পাবেন কোথায় ? – যেখানেই পাই প্রয়োজন পড়লে যেমন পাবো তেমন ছেলের কাছেই বিয়ে দিয়ে দিবো ।শ্বাশুড়ির কথা শুনে অয়নন্দিতা ভড়কে যায় । একদিকে রওশন বেগমও ঠিকঠাক ভাবছেন । মেয়ের এত বড় লজ্জার কথা বাহিরে জানাজানি হওয়ার আগেই মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছেন তিনি । একজন মায়ের চিন্তাভাবনা যেমন হয় তারও তেমন হয়েছে । কিন্তু অয়নন্দিতা ভাবছে অন্য কথা । এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিলে ওই ছেলে যে ভালো হবে তার কি গ্যারান্টি ? ওই ছেলে যে এইসব শুনতে বা জানতে পারলে সাজির সাথে খারাপ আচরণ না করবে তার কি গ্যারান্টি ?- মা , আমার মতে এইসব ব্যাপারে আস্তে ধীরে কাজ করলে হয় না ? – নাহ নাহ অয়নন্দিতা , আস্তে ধীরে না । এরপর জানাজানি হয়ে গেলে কে বিয়ে করবে আমার মেয়েকে । – কিন্তু মা বিয়ের পর ? বিয়ের পর যদি জানতে পারে তখন কি ওরা সাজিকে ভালো রাখবে ? – মানে,,,,,,? – আপনি জানাজানির ভয়ে ও-কে বিয়ে দিয়ে দিবেন , কিন্তু বিয়ের পর ? বিয়ের পর যদি ওরা জানতে পারে যে সাজির অতীত কি ছিল ? তখন কি করবেন মা ? তখন তো ওরা ওর সাথে খারাপ আচরণ করবে ? -……………. – মা , সাজি যা করেছে হয়তো অন্যায় করেছে । তবে মা সে ভালোবেসে করেছে , শুধু ভালোবাসার মানুষটা ভালো কিনা মন্দ সেটা বিচার করতে পারে নি । ভালোবাসার মানুষটা ছিল মা , ভালোবাসাটা ভুল ছিল না । আপনি মা , আপনি তো বুঝবেন মেয়ের কষ্ট টা । আপনি না বুঝলে বুঝবে কে মা ? সেদিন সাজি যা বলছিল তাতে বুঝলাম ও সুইসাইড করার চিন্তা করছে । – কিহহহহ ! – হ্যাঁ মা , আপনার মত সাজিও ভাবে ওর এইসব জানাজানি হলে , ওর বাবা মা ভাইয়ের সম্মান শেষ । মা এর থেকে ভালো হবে আরেকটু ভাবি আমরা , দেখি কি করা যায় ।ছেলের বউয়ের কথায় হুট করেই মনের মাঝে অনেকটা সাহস বেড়ে যায় রওশন বেগমের । অয়নন্দিতার কথাও ফেলনা নয় । তার কথাও সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত । হুটহাট সিদ্ধান্তে ক্ষতি হয় বেশি যেমনটা সাজি করেছিল । দুজনার কথার মাঝেই অয়নন্দিতার ফোন বেজে উঠে । বাবার বাসা থেকে ফোন এসেছে তার । শ্বাশুড়িকে বলে ভেতরে চলে যায় অয়নন্দিতা । আর রওশন বেগম না চাইতেও রান্নায় মন বসায় ।অয়নন্দিতার মায়ের ফোন এসেছে । মা মেয়ের কথার মাঝখানেই , হুট করে অয়নের বিয়ের কথা উঠে । রোকেয়া বেগম এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন । এখন ছেলেকে সংসারি করে দিতে পারলেই বাঁচেন তিনি ।- এত তাড়াতাড়ির কি আছে ? ভাইয়াকে আরেকটু সময় দেও । – আর কত সময় দিবো , এখনই সময় বিয়ের । তুই অয়নকে বুঝা , আর আমি এই ফাঁকে মেয়ে দেখা শুরু করি । – ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আমি , সব কিছুতেই তোমার এত তাড়াহুড়ো কেন , বলতে পারো ? – যেদিন মা হবি সেদিন বুঝবি , মায়েদের চিন্তা কতটা ? – সবে তো আমার বিয়েটা দিলে এখন অন্তত এক দেড় বছর যাক । – কিহহ , এক দেড় বছর । একেবারেই না , আমার ছেলে কি বুড়ো হলে বিয়ে করবে ? – তা তোমার ছেলে কি কচি বাচ্চা আছে নাকি ? – অয়নি , তোর না বড় ভাই হয় । কোথায় তুই আরও বুদ্ধি দিবি কিভাবে ভাইকে বিয়েতে রাজি করানো যায় , তা না তুই এইসব কি বলিস ? – এইসব আজাইরা বুদ্ধিতে আমি নাই । বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলছো ? – হ্যাঁ , – বাবা কি বলে ? – কি আর বলবে , বলে ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে ৷ তোর বাপের তো আজীবনের অভ্যাস , সব আমার উপর চাপিয়ে দেয় । আমি মা হয়ে ছেলেকে বিয়ের কথা কি জিজ্ঞেস করবো ? আর ছেলে কি আমার এতই ফ্রী নাকি যে আমায় তার মনের কথা বলবে ? – আমার বাপ ভালোই , তোমার জন্য কথা বলতে পারে না বেচারা । – সবাই ভালো খালি তোর মা-ই খারাপ । – আমার শ্বাশুড়ি মা অনেক ভালো । – তাই তো নিজের মাকেই ভুলে গেছিস , একদিনের জন্য থাকিসও না । – বিয়ে দিয়েছো সংসার করতে , সংসার করতেছি । বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থাকলে আর বিয়ে দিলে কেন ? – আমাদের উপর দেখি তোর অভিমান অনেক । – উহু , অভিমান না এটাই বাস্তব কথা । বুঝ হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি , আমাদের ছেড়ে কিংবা বাবাকে ছেড়ে একরাতের জন্যেও কোথাও গিয়ে থাকো নি তুমি । তবে তোমার মেয়ে হয়ে আমিই বা কি করে এমন করি বলো ? – যাক ঘটে ঢুকেছে তাহলে , এইবার ভাইকে রাজি করা । – মেয়ের সন্ধ্যান পেয়েছো নাকি ? – তোর চাচি নাকি দেখাবে একটা । ভাবছি কাল একবার যাবো । – আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলে দেখবো , আপাতত হুর হুর করে কোথাও যেও না , নয়তো ওইবারের মত বাবা আর ভাইয়ার বকা খেতে হবে ।মায়ের সাথে কথা শেষ করে লাইন কেটে পিছনে ঘুরতেই চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি আসে তার । এটা কি আল্লাহ পাকের ইশারা নাকি শুধুই একটা সংযোগ মাত্র , আর তাছাড়া সংযোগও তো আল্লাহ পাকের ইচ্ছাতেই হয় । তাহলে কি আল্লাহ পাক এইসব কিছু অয়নন্দিতার সামনে রেখে তাকে কোন ইংগিত দিচ্ছেন ?- বাহিরে থেকে মেয়ে আনবে কেন ? সাজি কেন আমার ভাইয়ের বউ হয়ে আমাদের বাসায় যেতে পারে না ? এতে সাজিও সুরক্ষিত আর ভাইয়াকেও আমি সব জানিয়ে দিবো । আর আমার ভাইও তো খারাপ না । লাখে একটা আমার ভাই , তাকে না মানার কোন কারণও নেই । মায়ের সাথে কথা বলবো একবার ? নাহ নাহ , আগে শ্বাশুড়ি মায়ের কানে কথাটা তুলি , দেখি তিনি কি বলেন ।একটা মেয়ে কতটা নিষ্পাপ আর তার ভেতরে থাকা মনটা কতটা ফেরেশতার মত হলে ননদের সব কিছু লুকাতে নিজের ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার চিন্তা করতে পারে সে ? হ্যাঁ , সে পারে , কারণ সে যে অয়নন্দিতা । তার ক্ষতি হয়ে যাক , সব শেষ হয়ে যাক । তবুও সে পরের ভালো চেয়ে যাবে আজীবন । দৌড়ে শ্বাশুড়ির কাছে যায় অয়নন্দিতা । রওশন বেগম তখন রুমে , টুকটাক কাজ করছিলেন । এমন সময় অয়নন্দিতা গিয়ে ডাক দেয় ,- মা ,,,,, ? – জ্বি , আসো অয়নন্দিতা । কি ব্যাপার মায়ের সাথে কথা শেষ হলো ? – হ্যাঁ মা , – কি বললেন আপা , বাসার সবাই কেমন আছেন ? – আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে । মা একটা কথা বলবো ? – হ্যাঁ , বলো না , কি বলবে ? – ভাইয়ার বিয়ের কথা চলছে । মা আমার ভাইয়ের সাথে যদি সাজির বিয়ে হয় আপনার কি কোন আপত্তি আছে ?অয়নন্দিতার কথা শুনে রওশন বেগম যেন আকাশ থেকে পড়েন । অয়নন্দিতা জেনে বুঝে শুনে কি বলছে এইসব ?- তুমি কি বলতেছো অয়নন্দিতা ? – হ্যাঁ মা , যদি ভাইয়ার সাথে সাজির বিয়ে দেয়া যায় , তবে কি কোন আপত্তি থাকবে আপনাদের ? – এটা কি করে সম্ভব ? – আমি সম্ভব করবো । – কিন্তু , সাজির এইসব শুনলে যে তোমার পরিবার আমার মেয়েকে মেনে নিবে তার কি গ্যারান্টি ? – তার গ্যারান্টি না হয় আমিই হবো মা । আমি সবটা সামলে নিবো । আপনি শুধু বাবার কানে কথা তুলুন । আমি বাসায় গিয়ে বাবার সাথে কথা বলবো । – কিন্তু ,,,,,, – মা , ভেবে দেখুন । সাজি পরের কাছে কেন থাকবে । ও আমাদের কাছেই থাকুক , যা হবে আপনারাও দেখতে পাবেন আর আমরাও । -………………. – কি হলো মা , আমার ভাইকে কি আপনাদের পছন্দ না ? – নাহ নাহ অয়নন্দিতা , অয়ন যথেষ্ট ভালো আর ভদ্র একজন ছেলে । কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা । সাজি শত আমার মেয়ে হোক , তার এইসব শুনে ওমন ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দেয়ার কথা বলবো কিভাবে ? এটা তো পরে খারাপ দেখাবে অয়নন্দিতা । – চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই মা । আপনি ভাবুন একবার , মায়ের আমায় ফোন করা , ভাইয়ার বিয়ের কথা বলা , এইদিকে আপনিও সাজিকে বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছেন । সব কিছুই আমাকে কেন্দ্র করে হচ্ছে মা । এটা আল্লাহ পাকের একটা ইশারা মা । হয়তো আল্লাহ পাকও তাই চাইছেন ।- আল্লাহ পাক চাইলেও আমি চাই না ভাবী । এইসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেও প্লিজ ।এমন কথায় অয়নন্দিতা এবং রওশন বেগম উভয়েই পেছনে ফিরে তাকায় । সাজি দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে । তার মানে সে সব টাই শুনেছে । তাই তো অয়নন্দিতাকে এইভাবে বলতে পেরেছে । অয়নন্দিতাও উঠে গিয়ে সাজির কাছে যায় । অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সাজির মাথায় হাত রেখে বলে ,- এখানে আপত্তির কি আছে সাজি ? – অয়ন ভাই অত্যন্ত সৎ আর ভালো মানুষ , আমি জেনে শুনে এইভাবে উনাকে এবং তোমার পরিবারের কাউকে ঠকাতে পারবো না ।- এটা শুধু আমি তুমি আর মা জানবো । আর কেউ তো জানবে না সাজি । – আজ জানবে না , কাল যে জানবে না তার কি গ্যারান্টি ভাবী ? তখন আমি আর আমার বাবা মা ভাই সারাজীবনের জন্য তাদের কাছে ছোট হয়ে থাকবো ভাবী । – সাজি ,,,,,,,, – আমি খারাপ ভাবী , খুব খারাপ । খারাপ না হলে কেউ এইভাবে ,,,,,,, যাই হোক জেনে শুনে ওই ভালো মানুষটার সাথে খারাপ কিছু করতে পারবো না ভাবী । – সাজি ,,,,,,, – যা বলেছি তাই , আর কিছু না । মা এইসবে একদম মাথা ঘামাবে না । তোমার মেয়ের কপাল সে নিজেই পুড়িয়েছে । তাকে জ্বলতে দেও মা , যাতে তার শিক্ষা হয় । আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে সেইদিনই নিজেকে শেষ করে দিতাম । তবুও নিজের দোষ ঢাকতে গিয়ে অয়ন ভাইয়ের মত ভালো মানুষের সাথে চিটারি করতে পারবো না আমি । ভাবী আমায় ক্ষমা করে দিও ।এই বলে সাজি সোজা বেরিয়ে যায় রুম থেকে । রওশন বেগমও আর তেমন কিছু বলেন নি । সাজির কথা শুনে তিনিও চুপ হয়ে গেছেন । আর অয়নন্দিতা যেন আশার আলো দেখেও আবার অন্ধকার দেখছে সামনে ।- আমিই সব ঠিক করবো , তোমাকে আমার ভাইয়ের সাথেই বিয়ে দিবো আমি সাজি ৷ তোমার জীবন এইভাবে নষ্ট হতে আমি দিবো না । আমি নিজ হাতে আমার ভাই আর তোমার সংসার গড়ে তুলবো । দেখি তুমি কি করে আটকাতে পারো । এটা তোমার বড় ভাবীর ওয়াদা ।।.চলবে……………………………………….
লেখক: জান্নাতুল ফেরদৌস
Leave a Reply