নিজস্ব প্রতিবেদক
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে গত মাসে। ওই মাসেই দেশে ২১৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন এসেছে, অপরাধীরা সাজা নিয়ে কতটুকু ভীত? মানবাধিকারকর্মী ও নারীনেত্রীরা বলছেন, দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে ধর্ষণ কমবে না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে দেখা গেছে, অক্টোবর মাসে শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, এ মাসে মোট ৪৩৬ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ৪৪ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণসহ মোট ২১৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১০১ শিশু ধর্ষণের শিকার এবং ২৫ শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া ১৬ শিশুসহ ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২৩ জনকে।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা না গেলে শুধু আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা যাবে না বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান। তিনি বলেন, ধর্ষক যদি মনে করে অপরাধ করে সে পার পেয়ে যাবে, সমাজে তার প্রভাব-প্রতিপত্তিতে কোনো প্রভাব পড়বে না, তাহলে সে শুধু আইনের ভয়ে ভীত হবে না। আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। ৯৭ শতাংশ নারী শিশু নির্যাতন মামলার বিচার হয় না, ধর্ষক জামিনে থাকে, এসবই তাদের জন্য গ্রিন সিগন্যালের মতো কাজ করে। ফলে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করলে শাস্তি হবে এবং সেখান থেকে বিনা শাস্তিতে রেহাই পাওয়ার কোনো পথ নেই সেটি যেন ধর্ষক বিশ্বাস করে তেমন পরিস্থিতি তৈরি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
শতকরা তিন ভাগ ধর্ষণের মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পায় উল্লেখ করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিচালক নিনা গোস্বামী বলেন, এসবের মাঝেই আছে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। ১০ বছর ধরে তারা প্রায় তিনশটি ধর্ষণের মামলায় আইনি সহায়তা দিচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেশিরভাগ মামলারই বিচার শেষ করা যায়নি। আইনে ছয় মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা বলা আছে। কিন্তু সেটা কাগজে কলমে, এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। যিনি তদন্ত করছেন, প্রথমত সময় লাগাচ্ছেন। তিনি অনেকবার সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করে আদালতে চার্জশিট দিচ্ছেন। এরপর আছে সাক্ষী হাজিরের বিষয়। ধর্ষণের মেডিকেল পরীক্ষা থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তাদেরই বেশকিছু সাক্ষ্য নিতে হয়, সেগুলোতে লম্বা সময় পর পর একাধিক ডেট পড়তে থাকে। সব মিলিয়ে ততদিনে ভিকটিম পরিবার ক্লান্ত হয়ে যায়। অপরাধ করার পরে বিচার হবে হবে করে যদি দীর্ঘ সময় বিচার না হয় তাহলে অপরাধীর ভয় কেটে যায়। এমনকি যারা এই অপরাধ মানসিকতা লালন করে, তাদের মধ্যেও অপরাধ করেও পার পাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে আইন বাস্তবায়ন করা জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেন, আইনে অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলো চিহ্নিত না করে শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান এনে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না। যখনই একজন নারী আসবেন আদালতে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে, এখানে প্রথমেই ধরে নেওয়া হয়, তিনি হয়তো সত্য কথা বলছেন না, তিনি মিথ্যা বলছেন। তিনি বলেন, যুগ যুগ ধরে একেবার ব্রিটিশ সময় থেকে চলে আসা ধারা আমরা শক্তিশালীভাবে লিগ্যাসি বহন করে বেড়াচ্ছি। অন্য সকল মামলার থেকে যখন ধর্ষণের মামলা হবে, এটার অর্থই হচ্ছে যে, একজন নিরপরাধ ব্যক্তি ফেঁসে যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, প্রো-অ্যাকিউস্ড (অভিযুক্তের স্বপক্ষে) অ্যাপ্রোচের পরিবর্তন দরকার। বিচার প্রক্রিয়ায় আমাদের গলদগুলো এত বেশি, সেগুলোকে অ্যাড্রেস করা প্রয়োজন। এই গলদগুলো এত শক্তভাবে শেকড় গেড়েছে যে, আপনি আইনে মৃত্যুদণ্ড লিখে দিলেই কোনো পরিবর্তন আসবে না।
আইনের দুর্বলতা নিয়ে তাসলিমা ইয়াসমিন আরো বলেন, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঘটে পারিবারিক সহিংসতা। এই পুরো আইনেই কিন্তু পারিবারিক সহিংসতাকে কোনো অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। এটা একেবারেই আনজাস্টিফাইঅ্যাবল, যখন এই আইনটার মূল বিষয়ই ছিল নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করা। এটা নিয়ে ভাবা দরকার ছিল যে, পারিবারিক সহিংসতাকে আমরা কেন অন্তর্ভুক্ত করছি না?
নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা যা রয়েছে, তাও সীমিত। সে কারণেও ধর্ষণের অনেক ঘটনায় সঠিক বিচার হয় না। তিনি বলেন, ধর্ষণের সংজ্ঞাটাকে কিন্তু আরো বিস্তৃত করতে হবে। সেখানে অস্বাভাবিক ধর্ষণের ঘটনা যেটা অনেক মামলায় আসছে, যেমন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যেটা হলো, এগুলো কিন্তু সবই ধর্ষণের সংজ্ঞায় আনতে হবে।
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান নারী নির্যাতন মামলার দীর্ঘসূত্রতার বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, বিচার থেকে শুরু করে তদন্ত- প্রতিটি পর্যায়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। হাইকোর্ট কিছুদিন আগেও একটা পর্যবেক্ষণে স্ট্রংলি বলেছেন, আইনে ১৮০ দিনের যে বিধান রয়েছে, সেটা কার্যকর হচ্ছে না। এটা যতটা কার্যকরভাবে তদারক করার কথা, সেটা আমরা দেখতে পাই না। তিনি বলেন, আরেকটা মামলায় হাইকোর্ট বিভাগই বলেছেন যে, একটা মনিটরিং সেল হবে। কিন্তু দুই বছর হয়ে যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে আমরা একটা শিথিল মনোভাব লক্ষ করে আসছি। এটা একটা বিরাট অন্তরায়।
উল্লেখ্য, গত ১৩ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২০ জারির বিষয়টি জানায়। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, আইনের ধারা ৯ (১) এ উল্লিখিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ করা হয়েছে। এর মানে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর আগে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
Leave a Reply